অটিজম

অটিস্টিক শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে মায়ের ভুমিকা

অটিজম সোমবার, ২৮ জানুয়ারী ২০১৯ ১২:৩৬:১৮

'তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই।
আজ যে শিশু, মায়ের হাসিতে ভেসেছে,
আমরা চিরদিন সেই হাসি দেখতে চাই।’

নবজাতক সন্তানের মুখ দেখে একজন মা কতই না খুশি হন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও মমতাময়ী দৃশ্যের একটি হলো, মায়ের  কোলে সন্তান। যেকোনো সন্তানের সব থেকে কাছের মানুষ হলো তার মা।  আর মায়ের সবথেকে কাছের ব্যাক্তিতে পরিণত হয় তার প্রাণ প্রিয় সন্তান।  কিন্তু তার সেই নাড়িছেঁড়া ধন যদি জন্ম থেকে বা জন্মের পর আর দশটা স্বাভাবিক সন্তান থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয় তখন সেই মা ছাড়া এই যন্ত্রণা আর কেউই অনুভব করতে পারে না।

অটিজম স্নায়বিক (নিউরোলজিকাল) সমস্যা, যা মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। রোগীর কথা বলতে সমস্যা হয়, এরা কথা বলতে পারনেনা। ভাষাগত সমস্যা সবথেকে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।  অন্যের কথা বুঝতেও পারে না। নতুন কিছু শিখতে ও সমাজের সবার সঙ্গে মিশতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। তারা স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারে না, খেলাধুলা করতে পারে না বলে অনেকে তাদের খেলায়ও নিতে চায় না।

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, যত্ন-আত্বি, খেলাধুলা ও বিনোদনের মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ অনেকটাই বাড়ানো সম্ভব। আর তাতে তারা সহজেই সমাজের মূলধারায় মিশে যেতে পারে।

অটিজমের উপসর্গ ব্যক্তি বা ক্ষেত্রবিশেষে নানারকম হতে পারে। অটিজমে আক্রান্তের প্রথম দিকে আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবেই অন্যের ওপর নির্ভরশীল জীবনযাপন করে। তবে সঠিক সেবাযত্ন ও পরিচর্যা পেলে কেউ কেউ অন্যের সামান্য সাহায্য নিয়েই কোনো কাজ করতে পারে। আক্রান্ত মানুষদের অধিকাংশই ঠিক করে কথা বলতে পারে না, একা চলাফেরা করতে পারে না এমনকি নিজেদের আবেগও প্রকাশ করতে পারে না। কখন, কোন বিষয় নিয়ে তারা রেগে যায় তারও অনুমান করা যায় না।

একজন অটিস্টিক শিশুর সবথেকে  কাছের মানুষ হয় তার মা। সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখেনা যে একজন অটিস্টিক শিশুর শারীরিক মানসিক বিকাশে তার মায়ের ভুমিকা ঠিক কতোখানি। যেহেতু তার মা ই সারাক্ষণ তার পাশেপাশে থাকে, তাকে বুঝতে পারে, তার কি প্রয়োজন,  কি ভালো লাগে, কি খারাপ লাগে সব কিছুর উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে শুধুমাত্র মা ই।  কেবল মা ই বুঝে নিতে পারে তার না বলা কথা। তার মুখ দেখেই বলে দিতে পারে আসলে শিশুটি কি চায়। একজন মা ই তার শিশুকে শতভাগ বুঝতে পারে। যা একজন ডাক্তার বা একজন শিক্ষকের ধারা বুঝা কখোনোই সম্ভব নয়।
সুতরাং, এ কথা তো বলাই যায় অটিস্টিক শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নতি অনেকাংশেই নির্ভর করে তার মায়ের উপর।

একজন সাধারণ মায়ের থেকে একজন অটিস্টিক শিশুর মায়ের দায়িত্ব কর্তব্য অনেক বেশী। অনেক বেশী সতর্ক, সচেতন, ও পরিশ্রমী হতে হয় মা কে।
মায়েদের অটিজম সর্ম্পকে স্বচ্ছ ধারণা থাকা ও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ জরুরি। যেহেতু মা ই সব থেকে  বেশি সময় ধরে সন্তানের পাশে থাকে তাই সবার আগে প্রয়োজন মায়ের প্রশিক্ষণ। যেমন, শিশুর ব্যক্তিগত দক্ষতা সে কি করতে ভালোবাসে, কি পছন্দ করে এসব বিষয়ে খেয়াল করতে হবে।

শিশুকে সব সময় পরিষ্কার   পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কারন, আমরা জানি একজন অটিস্টিক শিশু এমনিতেই পরিবার ও সমাজের কাছে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ভাবা হয়।  যদি তার পোষক, শরীর অপরিচ্ছন্ন হয় তবে সেই শিশুটি আরো বেশি হেনস্থার স্বীকার হবে। কারন একজন মানুষের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বা ভালো পোষাক পরিচ্ছেদের কারনেই অন্যের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। তাই অটিস্টিক  শিশুদের, পোশাক   বা পরিধেয় জিনিস পত্রের ব্যাপারে মাকে অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে। শুধু মাত্র সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাই নয় শিশুর সুস্থ থাকার জন্যেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে যে সমস্ত কাজ করতে হয় সব কাজই  ধাপে ধাপে শেখাতে হবে। বা কি করে সে সব অভ্যাস শিশুর আয়ত্ত্বে আনা যায় এ বিষয়ে মাকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে

যে কোনো অটিস্টিক শিশুরই বিশেষ কিছু লুকানো প্রতিভা থাকে। যা সবার নজরে আসেনা। কিন্তু সেই লুকানো প্রতিভা মাকেই খুজে বের করে আনতে হবে। এবং সেই প্রতিভার কি করে বিকাশ ঘটানো যায় সেই বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে।

অটিস্টিক শিশুর ভালোলাগা না লাগাকে প্রাধান্য দিতে হয়। কারন তারা তাদের মনের মতো কিছু না পেলে তাদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে। তাই তাদের ভালোলাগার জিনিষ গুলোর খোজ মাকেই করে নিতে হবে।

প্রত্যেকটি শিশুর জীবনে তার প্রথম শিক্ষক হয় তার মা। অটিস্টিক শিশুদের বেলাও তো এটি বেশি গ্রহণযোগ্য।  তাই শিশুর প্রথম শিক্ষক হিসেবে তার সন্তানকে আধো আধো কথা শেখানো থেকে পড়াশোনা সব কিছুর দায়িত্ব মাকেই নিতে হবে। তার কপমোর্ট জোনের ভেতরে থেকেই তাকে পড়াশোনা করার প্রতি উৎসাহ দিতে হবে।

পৃথিবীর সব দেশের অটিস্টিক শিশুদের জন্যে সরকারি বা বেসরকারি ভাবে কিছু সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়। এই     সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসমূহের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে হবে। ভালো করে জেনে তা ব্যবহার করতে হবে। কারন মনে রাখবেন,  এটি কোনো অনুদান নয় এটি অটিস্টিক শিশুর অধিকার। তাই সুযোগ সুবিধা গুলো নিতে কোনো ধরণের কার্পণ্য করা উচিৎ না।

প্রত্যেক শিশুর তার পৈতৃক সম্পত্তির পূর্ণ অধিকার রাখে। সে অটিস্টিক হলেও। তাই    শিশুর সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। হতে পারে সেই শিশুটি দুর্বল বলে তার অধিকার থেকে অনেকে তাকে বঞ্চিত করতে চাইবে। তাই এ সব বিষয়ে মাকে সচেতন হতে হবে।

অনেক সময় অটিস্টিক  শিশুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে তাদের উত্ত্যক্ত বা যৌনহয়রানীর মতো গর্হিত কাজ করে।  এসব কাজ অপরিচিত , পরিচিত বা খুব কাছের লোকজন দ্বারাও হয়ে থাকে। এতে করে শিশুটি শারীরিক ও মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। ভয় বা এক প্রকারের ট্রমার মধ্যে থাকে। এসব বিষয়ে মাকে খুব বেশি সচেতন হতে হবে। তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে সবার উপর ।  যাতে পরিচিত ও অপরিচিতজনের দ্বারা হয়রানি, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার না হয়  শিশুটি।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে। বিশেষ বিশেষ কাজ ভাই বোন বা অন্যদের মাধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। এতে পরিবারে সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ বিরাজ করবে।

অটিস্টিক শিশুর মা হিসেবে কখনোই লজ্জিত হওয়া যাবেনা। কারণ একজন মা যদি  বিষয়টি মন থেকে মেনে নিতে না পারেন তাহলে সেটি মায়ের আচরণের মাধ্যমেই প্রকাশ পাবে যা শিশুর বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে চাপমুক্ত হওয়ার কৌশল অর্জন ও মানসিকভাবে মানিয়ে নেওয়ার কৌশল অর্জন করতে হবে। ছাপ মুক্তি বা মানসিক প্রশান্তির জন্যে মা তার যেকেনো বন্ধু বা কাছের মানুষের সাথে তার  সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারে। এতে করে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়। অথবা, মা ও শিশু মিলে কোনো পার্ক বা লেকের ধারে ঘুরে আসতে পারে। ফলে মন শরীর দুটোই ফুরফুরে হয়।

শিশু পরিচর্যার সাথে সাথে মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা দরকার। এ জন্য ব্যক্তিগত জীবন উপভোগ করতে হবে।, অন্যথায় একসময় মানসিক শক্তি,ধৈর্য নিঃশেষিত হয়ে যাবে ও মা ভেঙে পড়বে। যা শিশুর জন্যে মোটেও সুখকর নয়।

অনেক সময় অটিস্টিক শিশু ও তার ভাইবোনদের মধ্যে মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা দেখা যায়। অটিস্টিক শিশুটর প্রভাব তার ভাই বোনদের মাঝেও পড়তে পারে।   এ জন্য চিকিৎসক ও পরামর্শকের সহায়তা প্রয়োজন।

অটিস্টিক শিশুকে লোকসমাজে উপস্থাপন করতে হবে। অটিস্টিক শিশুরা অপরিচিত ও বাইরের পরিবেশে এলে অনেক সময় অস্থিরতা ও অপ্রত্যাশিত আচরণ করে থাকে। এ জন্য আগে  থেকেই তাদেরকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে রাখতে হবে।  যাতে করে সে কোনো ক্ষতিকর আচরণ থেকে বিরত থাকে। পূর্ব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জায়গার মানচিত্র, ছবি বা ভিডিওচিত্র প্রদর্শন অনেকাংশে ভালো ফল দেয়। এ ছাড়াও এসব পরিস্থিতিতে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল অর্জন করতে হবে। অন্যথায় এটি শিশুর মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সরকারি পর্যায়ে অটিস্টিক শিশুদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকলেও বিদ্যামান প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র,  বা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে অনেক আশানুরূপ সেবা পাওয়া সম্ভব। তাই এসব বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে।

ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে অটিজম বিষয়ক সচেতনতা তৈরি  করতে হবে। অটিস্টিক শিশুর বেড়া ওঠায় এটি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অটিস্টিক শিশুর সুস্থ বিকাশ ও  সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে একমাত্র  অটিজমবিষয়ক সচেতনতাই পারে অটিস্টিক শিশুদের একটি স্বাভাবিক জীবন উপহার দিতে।

তাই একজন মায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো  অটিস্টিক শিশুটির বন্ধু, সহপাঠী বা তার শিক্ষকদের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করা।
কিছু কুসংস্কার ও গর্হিত  কথা বার্তায় মোটেও কান দেয়া যাবেনা। অটিজম যে কোনো অভিশাপ নয় এবং এটি যে কারো হতে পারে বা এটি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত কোনো পাপ কাজের শাস্তি ও নয়- এটি মনে প্রানে বিশ্বাস করতে হবে।  

একজন অটিস্টিক শিশুর সবার আগে প্রয়োজন  একজন সচেতন ও সহনশীল মা।  মায়ের যত্ন, ভালোবাসা  আর সচেতনতাই পারে অটিস্টিক শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে।