অন্ধত্ব

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং অন্ধ শিশুর আচরণঃ পিতামাতার জন্য নির্দেশিকা

অন্ধত্ব রবিবার, ২১ জুন ২০২০ ১১:৪০:৪৬

পিতামাতা হিসাবে আপনার অন্ধ বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সম্পন্ন সন্তানকে নিয়ে আপনার আশা আকাংখা ও স্বপ্ন রয়েছে। বেশিরভাগ বাবামায়ের আশা হচ্ছে তাদের শিশু সুস্থ ও সুখী থাকবে এবং বেড়ে উঠবে কিছু দক্ষতা অর্জন করে যার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক হলে সে স্বাধীনভাবে নিজের জীবন যাপন করতে পারে। সীমিত দৃষ্টির শিশুর প্যারেন্ট হিসাবে আপনি এও জানেন যে কখনো কখনো এমন সময় আসবে যখন আপনার মনে অনেক প্রশ্ন তৈরি হবে কিন্তু কি করতে হবে জানেন না। একটা সাধারণ প্রচলিত কথা আছে যে কোন শিশু গাইড বই হাতে নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। যাই হোক, আপনার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সম্পন্ন শিশুর উন্নয়নে এবং তার শিক্ষন প্রক্রিয়ায় কিভাবে সাপোর্ট করতে হবে এইসব বিষয়ে আপনাকে অবশ্যই কিছু পড়ালেখা করতে হবে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে যারা দক্ষ তাদের সাথে আলোচনা করুন এবং তাদের সাথে কথা বলুন। শিশুকে গাইড করার জন্যে যে বিশেষজ্ঞই আনুন না কেন, মনে রাখবেন আপনিই এ ব্যাপারে আপনার সন্তানের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবেন। কারন একমাত্র আপনিই আপনার শিশু ও শিশুর আচরণ সম্পর্কে সবার চেয়ে ভাল জানেন।

স্কিল ডেভেলপমেন্ট পর্যবেক্ষন করা
বাবা-মা হিসাবে আপনি শিশুর জন্ম মুহূর্ত থেকেই তার আচরণ পর্যবেক্ষন করতে শুরু করেন। আপনি তার চুলে, টাক মাথায় হাত স্পর্শ করেন, তার হাতের ও পায়ের আঙ্গুল গুনে দেখেন – আপনি আসলে নিশ্চিত হতে চান সব ঠিক আছে কি না। তারপর আপনি যখন তাকে আদর করেন তখন তার কাছে যান, ছোট্ট হাত স্পর্শ করেন এবং দেখেন সে আপনার আঙ্গুল ধরে কি না। এইটা হচ্ছে নবজাতক শিশুর অন্যতম একটা প্রাথমিক আচরণ যা আপনি লক্ষ্য করেন। আপনি যখন শিশুর দিকে তাকান আপনি তার কিছু প্রয়োজন আছে কিনা তা ভাবেন। সে কি ক্ষুধার্ত, শীত লাগছে বা ভিজে আছে? তাকে শান্ত করার জন্য আপনার কি কিছু করার আছে? প্রাথমিক দিনগুলো, তারপর মাসগুলো যখন কেটে যায় তখন আপনি শিশুর আচরণে কিছু পরিবর্তন খেয়াল করেন। সে আপনাকে বলতে পারেনা তার কি প্রয়োজন কিন্তু তার আচরণ আপনাকে কিছু ক্লু দেয় যেগুলো থেকে বুঝতে পারেন তার এখন যত্ন প্রয়োজন।

আপনার শিশুর নতুন নতুন স্কিল এবং সীমিত দৃষ্টি শক্তি নিয়ে তার জগতে নিজেকে কিভাবে খাপ খাওয়ায়  দেখে দেখে “প্যারেন্ট এক্সপার্ট” হিসাবে আপনার দক্ষতা গড়ে উঠে। শিশুর একেকটা নতুন স্কিল টের পান আর আপনি সম্ভবত সবাইকে তা জানিয়ে উদযাপন করেন!

“বাবু মাথা উঠাইছে!”, “বাবু গড়াগড়ি করছে!”
“বাবু কথা শুনার জন্য আমার মুখের দিকে কান ঘুরাইছে!”  
“বাবু কু কু আওয়াজ করছে!”, “বাবু আমতা আমতা করতেছে!”, “বাবু প্রথম কথা বলছে!”
“বাবু হাসি দিল!”, “বাবু বালুর ঢিপিতে পুতুল রাখছে!”, “বাবু হাত তালি দিয়েছে, ওর বোন যখন কান্না করে!”     
     
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সম্পন্ন শিশু যে দক্ষতা অর্জন করতে পারে না বা দেরি করে অর্জন করে
নতুন যা কিছু দক্ষতা আপনি শিশুর মধ্যে দেখেছেন এসবই হচ্ছে তার আচরণ – আচরণগত দক্ষতা। আরও যা আপনি হয়ত খেয়াল করেছেন তা হল কিছু দক্ষতা তার নাই বা দেরি করে আয়ত্ব করছে। আপনি পরবর্তীতে আরও বড় বড় বিষয় লক্ষ্য করবেন, যেমন, না দেখে নড়াচড়ায় সমস্যা এবং পর্যবেক্ষন করে কোন কিছু শিখতে পারায় কম দক্ষতা (incidental learning)। আপনি দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে আপনার পরিবারের সাথে, বন্ধুবান্ধবের সাথে, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে, বা আপনার দলের অন্য কোন প্রফেশনাল এর সাথে এই বিষয়টি শেয়ার করবেন।
“কেন আমি কথা বলার সময় বাবু মনোযোগ দেয় না বা খেয়াল করে না?”
“কেন বাবু শক্ত খাবার খায় না? আমরা কিভাবে তাকে খাওয়াব?”
“বাবু কেন কথা বলা শুরু করে না? মুখ নাড়ায় কিন্তু ‘মা মা’ ছাড়া আর কিছু বলে না”।
“বাবু কেন নিজে নিজে বসতে পারে না?”
“বাবু কেন হামাগুড়ি দেয় না? এটা কি স্বাভাবিক?

এধরণের অবস্থায় আপনাকে নতুন কিছু ফোকাস করতে হবে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সম্পন্ন শিশুকে শেখানোর কোন পদ্ধতি, নতুন কিছু কৌশল যেমন হাতের উপর হাত বা হাতের নিচে হাত, early intervention service গ্রহন করা এবং এমন কোন এক্সপার্ট এর সহায়তা নেয়া যার রয়েছে visual impairment develop good motor skills, ইত্যাদি অবলম্বন করলে আপনার শিশু পরের স্টেপগুলিতে এগিয়ে যেতে পারবে। ছোট ছোট অগ্রগতি উদযাপন করবেন তখন! শিশুর বিলম্বে শিখার বিষয়টি আপনার “এক্সপার্ট” পর্যবেক্ষনে আসায় তার অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সম্পন্ন শিশুর প্রত্যাশিত অসুবিধাজনক আচরণসমুহ
আপনার শিশুর হাঁটতে শেখার বয়স থেকেই কিছু নতুন আচরণ লক্ষ্য করবেন, কিন্তু এগুলোকে দক্ষতা গড়ে উঠছে বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না। তারা যাই করুক, তারা আসলে সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে! প্রথম প্রথম এই আচরণগুলো খুব গুরুত্বপুর্ণ মনে হবে না। আসলে কিছু কিছু আচরণ স্বল্প সময়ের জন্য দেখা যাবে, পরে আর দেখা যাবে না। দেখা যাবে যে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, অন্যান্য প্যারেন্টস, এবং ডে কেয়ার স্টাফেরা এসকল নতুন “সমস্যা” আচরণে অবাক হন না এবং আপনি এধরণের মন্তব্য শুনতে পাবেন-

“ওহ, এ তো ‘সামান্য ব্যাপার’”
“এর থেকে সে বেরিয়ে আসবে”
“সে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাইছে”।
“সে একা একা খেলে মজা পাচ্ছে”।
“সে নিজের জিনিসপত্র রক্ষা করতে এমন করছে”।

“সমস্যা” আচরণগুলো হয়ত প্রত্যাশিত এবং পরিচিত কিন্তু এগুলো বেশ হতাশাজনক। ধাক্কা দেয়া, কিছু ছুড়ে ফেলা, খামচে ধরা, অথবা এমনকি কামড় মারার মত আচরণ দেখা যাবে বাসায় অথবা ডে কেয়ার সেন্টারে। আপনার মনে হবে “কোথা থেকে এইসব আচরণ আসল? সে-তো কত স্বাভাবিক ছিল!” এটা প্রমাণ করে যে এইসব আকস্মিক আচরণের সাথে ডেভেলপমেন্ট চেঞ্জ এর পরিস্কার সম্পর্ক রয়েছে। হাঁটতে শেখার বয়সে স্বাধীনভাবে চলতে কাউকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়া, কোন কাজ নিজে নিজে করার প্রবনতা, এবং মুহুর্তে আবেগের মধ্যে কোন বড় পরিবর্তন ইত্যাদি আসলে “সমস্যা” আচরণ। আপনি কিছু কৌশল অবলম্বন করতে পারেন নিজের বুদ্ধিতে অথবা আপনার দল থেকে কারো সাহায্য নিতে পারেন যে এসব বিষয়ে কিভাবে রেসপনড করতে হয় জানে। কোন কোন দিন বেড়ে উঠার কালে এইসব আচরণ মেনে নেয়া কঠিন মনে হবে, কিন্তু মনে রাখবেন আপনি এক্সপার্ট। আপনার শিশুকে বুঝতে দিন যে আপনি তাকে সাহায্য করতে চান। দিনশেষে আপনার মনে হতে পারে এ ধরণের শিশুর প্যারেন্ট হওয়া কত কঠিন!

এধরণের পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণে কি করার আছে? আপনি হয়ত কিছু এমন আচরণও দেখেন যেগুলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সম্পন্ন শিশুর জন্য অস্বাভাবিক নয়। সে হয়ত চোখ টিপটিপ করে, শরীর ঝাঁকায়, মাথা উপর-নিচ করে, শুন্যে হাত ছুড়ে মারে কিংবা আলোর দিকে চেয়ে থাকে। এসব পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণগুলোকে stereotypical behaviors or mannerisms বলা হয় এবং এগুলো স্ব-উদ্দীপনা থেকে হয়। অন্যান্য আচরণের মতই এটাও বুঝতে পারা গুরুত্বপুর্ণ যে কেন তারা এমন করছে এবং তাদের ব্যাপারে কী করা যায়।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সম্পন্ন শিশুদের চ্যালেঞ্জিং আচরণসমূহ
“প্যারেন্ট এক্সপার্ট” হিসাবে আপনি আশা করেন শিশুর ডেভেলপমেন্টে এবং আচরণে পরিবর্তন আসুক। আপনার শিশুর স্কিল এবং ডেভেলপমেন্ট সংশ্লিষ্ট আচরণ ব্যাবস্থাপনা সম্পর্কে আপনি জানুন। কখনও কখনও বাবা-মা কিছু অপ্রত্যাশিত, বিভ্রান্তিকর এবং উদ্বেগজনক আচরণ পর্যবেক্ষন করেন। এইসব আচরণগুলিকে একশব্দে বর্ণনা করলে “চ্যালেঞ্জিং” বলতে হয়। রূপক ইউজ করে বলা যায় এটা একটা নতুন কর্মক্ষেত্র।

এই আচরণগুলো সবসময় একরকম নয়। এগুলো নিম্নরূপঃ

শিক্ষণে বাঁধা সৃষ্টি করে।
গৃহে এবং সমাজে - দৈনন্দিন জীবন বিঘ্নিত করে।
কখনও কখনও অন্যের বা নিজের ক্ষতি সাধন করে।
কখনও কখনও জিনিসপত্রের ক্ষতি সাধন করে।
শিশুর, শিশুর বাবা-মায়ের এবং পরিবারের জীবনের উপর তাৎপর্যপূর্ণ চাপ সৃষ্টি করে।  

শিশুর বৈকল্য এবং তার অগ্রগতি সম্পর্কে আপনি সবসময় প্রস্তুত নাও থাকতে পারেন। আপনি যেসব কৌশল অবলম্বন করেছেন সেসব কাজে নাও আসতে পারে। শুধু আপনিই নন – আপনার ঘনিষ্ট কোন বন্ধু, অথবা শিশু বিশেষজ্ঞ, স্কুলশিক্ষক, থেরাপিস্ট, বিশেষজ্ঞ – এরা সকলেই তাদের পর্যবেক্ষণ এবং চিন্তাগুলো আপনাকে রিপোর্ট করবে।

আপনি “প্যারেন্ট এক্সপার্ট”, কিন্তু এখন আপনাকে “আচরণ এক্সপার্ট” হবার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনি সবচেয়ে ভাল জানেন আপনার শিশু সম্পর্কে। আপনি এক্সপার্ট। কিন্তু আপনার উত্তর জানা নাও থাকতে পারে। আপনার সহায়তা এবং সাপোর্ট প্রয়োজন। এখন আপনার দরকার অন্যের পর্যবেক্ষণ, ব্যাখ্যা এবং আচরণগুলোর সম্ভাব্য কারণ জানা। এখন আপনার লক্ষ্য আচরণগুলোর মাত্রা কমানো এবং যথোপযুক্ত সমাধান খোঁজা। একটি নতুন শব্দগুচ্ছ আপনার কাছে এখন পরিচিত হবে এবং তা হল – সকল আচরণই কমুনিকেশন বা যোগাযোগ। আবার আপনি আপনার শিশুর এক্সপার্টে পরিনত হবেন এবং সে কি বলতে চায় সে ব্যাপারে অন্যদের সাহায্য করবেন।