বধিরতা

বধিরতা ও ভাষাগত সমস্যায় করণীয়

বধিরতা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০৫:২০:৩৪

মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা। কথা বলতে পারা ও কথা শুনতে পারা দুটোই মানব জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  লোকে বলে জন্মের পর শিশুর প্রথম কান্না নাকি সবচেয়ে শ্রুতিমধুর কান্না। সেই শিশু ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে। তার হাসি-কান্না আর আধো আধো বুলি পুরো পরিবারকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে সক্ষম। তবে কখনো কখনো অনেক মা-বাবাই অভিযোগ করেন, শিশু নাকি বয়স অনুযায়ী কথা বলছে না বা কানে শুনতে পাচ্ছেনা। অনেকে এমনও বলেন যে শিশু কিছু শব্দ বলছে, কিন্তু যথেষ্ট বয়স হওয়ার পরেও পূর্ণ বাক্য বলতে পারছে না।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মা-বাবা দুজনই কর্মজীবী হলে সারা দিন শিশুটিকে দেখভাল করার মানুষ পাওয়া গেলেও তার সঙ্গে কথা বলার মতো কেউ থাকে না। এর ফলে তার মধ্যে কথা বলার প্রবণতা শুরু থেকেই কম থাকে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে, শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কোনো সমস্যা না থাকলেও কোনো শিশু একটু দেরিতে কথা শিখছে। এদের কোনো ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, বরং চার-পাঁচ বছর বয়স নাগাদ তারা নিজেরাই স্বাভাবিকভাবে কথা শিখে যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা বললেন, শিশুকে সময় দেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুর বয়স অনুযায়ী তাকে খেলনা কিনে দিন এবং তার সঙ্গে খেলুন। তাকে ছড়া বা গল্প শোনাতে পারেন। ছবির বই দেখিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। সে যেসব বিষয়ে মজা পাবে, সেগুলোই তার সামনে করুন বা বলুন।

কেনোই বা বাচ্চারা বয়সের সাথে সাথে বলতে ও শুনতে পায়না?

এ ধরনের সমস্যা যাদের হয়, তাদের অধিকাংশের মা-বাবা শিশুটিকে পর্যাপ্ত সময় দেন না। এই শিশুদের শান্ত রাখার জন্য প্রায় সারা দিনই টেলিভিশনে কার্টুন দেখানো হয় অথবা মোবাইলের রিংটোন শোনানো হয়। কাজেই তাদের মধ্যে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতা তৈরি হয় না।

এ ছাড়া গর্ভকালীন সময়ে মা যদি নির্দিষ্ট কিছু জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হন, শিশু জন্মের সময় যদি কোনোভাবে মস্তিষ্কে আঘাত পায় বা শিশু যদি জন্মের পরপরই না কাঁদে, তাহলেও পরবর্তীকালে শিশুর কথা বলতে অসুবিধা হতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, গুরুতর কোনো মানসিক আঘাত অথবা অটিজমের কারণেও এমনটা হতে পারে ।

জন্মের ছয় সপ্তাহ থেকেই শিশু বিকট আওয়াজে ভয় পেয়ে যায়। এটি দেখে ধারণা করা যেতে পারে যে সে কানে শুনছে। তিন মাস বয়স থেকেই শিশু নিজে থেকে মুখ দিয়ে নানা রকম আওয়াজ করতে পারে। দুই বছর বয়সী একটি শিশুর গড়ে ৫০০-১০০০ শব্দের মানে বুঝতে পারার কথা এবং সেগুলো বলতে পারার কথা। এক-দুই বছরের মধ্যে শিশু কথা বলতে না শিখলে তাকে শিশুবিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

আজকাল অনেক মা-বাবাই নিজেদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকছেন। শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যেই ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে শতব্যস্ততার মধ্যেও শিশুকে সময় দিতে হবে। আর কোন বয়সে শিশুর কোন ধরনের বিকাশ কতটা হবার কথা,তা ইন্টারনেট থেকে জেনে নিতে পারেন।
টেলিভিশন, কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে শিশুকে খাওয়ানো বা তাকে এগুলো দেখিয়ে শান্ত রাখা থেকে বিরত থাকুন।

শিশু যদি শুনতে না পায়, তাহলে তার বধিরতার চিকিৎসা লাগবে। যারা ঠিকমতো কথা বলছে না, তাদের জন্য লাগতে পারে স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি।

শিশু চিকিৎসার পর কথা বলতে পারবে কি না, তা নির্ভর করে শিশুর বয়স ও তার সমস্যাটির ওপর। বেশি বয়স হয়ে গেলে তাকে নতুন করে কথা শেখানো মুশকিল। আর শিশুর উচ্চারণগত সমস্যা থাকলে শিশু কথা বলতে শেখার পরে তাকে উচ্চারণ শুদ্ধ করার করার জন্যে স্পিচ থেরাপি দেওয়া যেতে পারে।


এবার আসা যাক কানের যত্নে যা যা করনীয়ঃ
১. কানে কোনো কিছুই ঢোকানো যাবে না। এমনকি কান পরিষ্কার করার জন্য কাঠি, মুরগির পালক বা কটন বাড ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই।
২. খৈল জমে কান বন্ধ ভাব হলে বা কানের মধ্যে বাইরের কোনো বস্তু প্রবেশ করলে অপসারণ করতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
৩. চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কানে তেল বা অন্য কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না।
৪. কানে যাতে পানি না যায়। সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
৫. আঘাতজনিত বা মধ্যকর্ণের প্রদাহ বা অন্য কারণে কানের সমস্যা মনে হলে অবহেলা না করে যত দ্রুত সম্ভব নাক কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ।
৬. যত্রতত্র হর্ন বাজানো, লাউডস্পিকারে উচ্চশব্দ, হেডফোন ব্যবহার ও কল-কারখানার শব্দ সহনীয় মাত্রায় রাখতে হবে।
৭. শিশুদের টনসিল/ এডেনইড/ সাইনাসের প্রদাহ এবং নাক ও গলার অ্যালার্জির চিকিৎসা করানো।
৮. শ্রবণমাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করুন।

আসলে বধিরতা বা কানে না শোনার সমস্যা সমাধানে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। বর্তমানে জন্মগতভাবে বধির শিশু ও বড়দের শ্রবণজনিত সমস্যার অত্যাধুনিক চিকিৎসা দেশেও রয়েছে। তবে এসব জটিল চিকিৎসা ও অপারেশনের জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল। সুতরাং বধিরতা প্রতিরোধ ও নিরাময়ে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, শ্রবণযন্ত্র, ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টসহ অত্যাধুনিক চিকিৎসা সামগ্রী সহজলভ্য করে তোলা প্রয়োজন এবং সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে সচেতনতা।

 

তথ্যসূত্রঃ ১। https://www.medicalnewstoday.com/articles/249285.php

            ২। https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/deafness-and-hearing-loss