অটিজম

অটিজম আক্রান্তদের ইকোলালিয়া

অটিজম বুধবার, ১০ জুন ২০২০ ০৯:৩৬:৩৩

কথা বলার ক্ষেত্রে এবং ভাষার দক্ষতা অর্জনে পুনরাবৃত্তি এবং অনুকরণ গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।  কিন্তু অটিজম শিশুদের ক্ষেত্রে এই বিভাগে/ব্যাপারে বেশ সমস্যা রয়েছে। এর কিছু লক্ষণ আছে যা থেকে পিতা-মাতা হিসাবে আপনি ভালই বুঝতে পারবেন আপনার শিশুর এই সমস্যা আছে কি না।   

ইকোলালিয়া কি?

একই শব্দ বা শব্দগুচ্ছ বারবার উচ্চারণ করাকেই ইকোলালিয়া বলে। কথা অনুকরণের এটা এক অনন্য উপায়। ছোট্ট শিশুরা যে সব শব্দ শুনে তা অনুকরণ বা নকল করতে করতেই কথা বলা শেখে। বয়স বারার সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠা শিশু ভাষা ব্যাবহার করে যোগাযোগ করতে শুরু করে দেয়। বয়স তিন বছর হতেই মোটামুটি সব শিশুই শব্দ বাছাই করে শব্দগুচ্ছ তৈরি করতে এবং শব্দগুছ ব্যাবহার করে কথা বলতে পারে। যোগাযোগ স্থাপন করতে তারা ভাষাকে তাদের নিজের মত করে অভিনব পন্থায় ব্যাবহার করে ।

যোগাযোগ স্থাপনে অটিজম শিশুদের ক্ষেত্রে ইকোলালিয়া একটি অন্যতম কমন বা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট।

অটিজম আক্রান্তদের মধ্যে ইকোলালিয়া সমস্যা থাকার কারণগুলো কি কি?

একজন মানুষের ইকোলালিয়া প্রবণতা হওয়ার একাধিক কারন থাকতে পারে। হয়ত সে তার
১। কথা চালিয়ে যেতে চায়
২। কারো মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়
৩। মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়া মানে ভাব বিনিময় করতে চায়।
৪। কোন কিছু জানতে বা পেতে চায়

একজন ব্যাক্তির মধ্যে ইকোলালিয়া প্রবণতা থাকার সাধারণ কারন এগুলোই । কিন্তু যখন ব্যাপারটি অটিজম আক্রান্তদের মধ্যে হয় তখন অন্য রকম হতে পারে।

অটিজম শিশুদের অনেকেই শব্দ উচ্চারণ করে। কখনো কখনো দেখা যায় তাদের শব্দভাণ্ডারও বেশ সমৃদ্ধ। কিন্তু তারা সেগুলো ব্যাবহার করে একই সুরে এবং একই রকমভাবে। মনে হয় যেন তারা এসব কারো কাছ থেকে শুনে বা টেলিভিশন থেকে দেখে বলছে। ইকোলালিয়ার বেশ কিছু উদ্দেশ্য থাকতে পারে এবং তা সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তনও হতে পারে। আবার একই সময়ে কোন ব্যাক্তির একাধিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।

মানসিক কোন অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতেঃ কিছু অটিস্টিক শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক লোকেরা কথা অনুকরণ করে সেই কথার অর্থ কিছু না বুঝেই। সম্ভবত নিজেদেরকে শান্ত রাখতে তারা একাজটি করে। ইকোলালিয়া এক্ষেত্রে একধরনের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল।

চিন্তা-ভাবনা অন্যকে বোঝাতেঃ নিজস্ব কথার ধরণ দিয়ে যখন অন্যকে নিজের চিন্তা-ভাবনার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে না তখন অটিস্টিক মানুষ  ইকোলালিয়ার আশ্রয়ে হয়ত অন্যের সাথে চিন্তা-ভাবনার যোগাযোগ ঘটাতে চেষ্টা করে। তারা আগেই প্রয়োজনীয় শব্দগুচ্ছ বা কি বলবে তা মাথায় তৈরি করে রাখে। অনেক অটিজম শিশুর ক্ষেত্রেই তাদের কথা বলার সাধারণ ধরণ হিসাবে এটা একটা গুরুত্বপুর্ণ পদক্ষেপ।  

নিজকে সাহায্য করতেঃ অটিজম আক্রান্তরা নিজেদের সুবিধার্থে ইকোলালিয়াকে মাধ্যম হিসাবে ব্যাবহার করে। তারা যেসব শব্দ বা শব্দগুচ্ছ বাবা-মায়ের মুখে বা টেলিভিশনে শুনে সেগুলো ব্যাবহার করে।

সম্পর্ক গড়ে তুলতেঃ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যম হিসাবেও ইকোলালিয়া ব্যাবহার হতে পারে। সামাজিক নৈকট্য বা বন্ধন দৃঢ় করতে অটিস্টিক ব্যাক্তি এটা ব্যাবহার করতে পারে।এটা অন্য মানুষের সাথে ভাব বিনিময় করতে এবং নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে অটিজম আক্রান্তদের সাহায্য করে।  

নিজের চাহিদা জানাতেঃ অটিস্টিক শিশু নিজের কি প্রয়োজন তা প্রকাশ করার মাধ্যম হিসাবে ইকোলালিয়ার আশ্রয় নিতে পারে। এটা কোন কিছু বিবৃত করতে, কাউকে ডাকতে অথবা কোনকিছুর জন্য অনুরোধ করার একটা উপায় হতে পারে।

ইকোলালিয়ার ধরনঃ

দুই ধরনের ইকোলালিয়া রয়েছে – তাৎক্ষণিক (Immediate) ইকোলালিয়া এবং বিলম্বিত(Delayed) ইকোলালিয়া।

তাৎক্ষণিক ইকোলিয়াঃ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে যখন অটিস্টিক শিশু পুনরাবৃত্তি করে তখন সেটাকে তাৎক্ষণিক ইকোলালিয়া বলে। একদম সাথে সাথেই প্রতিধ্বনিত করার মত। যেমন, বাবা বা মা হয়ত জিগ্যেস করল “তুমি কি কোক খাবে?” এবং সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটি রেসপন্স করল “কোক খাবে।” এই ক্ষেত্রে হয়ত শিশুটা আসলেই কোক খাবে। কিন্ত সে নতুন শব্দ “হ্যাঁ, খাব” না বলে বাবা-মাকে ইকো করে।  এই ধরণের ইকোলালিয়াকে শিশুর কথা বলা শেখার একটা পথ হিসাবে ব্যাবহার করা যেতে পারে। অন্যে কি বলে তা শুনে তার সাথে কথকোপথনের মাধ্যমে যোগাযোগ সৃষ্টি করার একটা উপায়ও তা হতে পারে।  এমনও হতে পারে যে শিশুটি বাবা-মায়ের প্রশ্নের সঠিক জবাব দেবার জন্য প্রয়োজনীয় সময় ইকোলালিয়ার মাধ্যমে নিচ্ছে। আবার তাৎক্ষণিক ইকোলালিয়া যোগাযোগ স্থাপনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত শিশুটি শেষ শব্দটি ইকো করে, অথচ তার চাওয়া অন্যকিছু হতে পারে।

বিলম্বিত ইকোলিয়াঃ যখন একজন অটিস্টিক কোন শব্দগুচ্ছ মুখস্থ বলে অর্থাৎ স্মরণ করে বলে তখন সেটাকে বিলম্বিত ইকোলালিয়া বলে। কোন বই থেকে বা টেলিভিশন থেকে কোন শব্দগুচ্ছ বা কোন অনুচ্ছেদ হয়ত কখনও শুনেছিল, তা অনেকদিন পরে সে বারবার যেমন শুনেছিল তেমন করে বলতে থাকে।   
হয়তবা অটিজম শিশুদের কিছু শুনলে তা মনে রাখার কোন বিরাট গুন আছে। এই গুনের কারনেই হয়ত তারা যা শুনে তা পরে মুখস্থ বলতে পারে।
যখন সে মুখস্থ কোন কিছু বলে, কোন নির্দিষ্ট লাইনই হোক বা কোন বড় স্ক্রিপ্টের অংশই হোক, তা অনেক জটিল ধরনের হয়। সে নিজে যখন কোন শব্দ বা বাক্য তৈরি করে তখন এত জটিল বাক্য তৈরি করতে পারে না।এটা বিলম্বিত ইকোলালিয়ার বৈশিষ্ট। সে যা বলে তা সবসময় পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না, এমনকি খাপই খায় না। পুনরাবৃত্তি করা বাক্যটি আসলে তার কোন একসময়ের কোন তাৎপর্যপূর্ণ স্মৃতি বা আবেগ।
 
বিলম্বিত ইকোলালিয়া কেন হয়?

আগেই বলেছি অটিস্টিক মানুষের ক্ষেত্রে ইকোলালিয়া দু’চার ধরণের উদ্দ্যেশ্য সাধন করে। তেমনি, অটিস্টিক ব্যাক্তির শব্দগুচ্ছ প্রতিধ্বনিত বা ইকো করার একাধিক কারণ রয়েছে।
বিলম্বিত ইকোলালিয়া হতে পারে --  
স্ব-উদ্দীপনার পন্থাঃ অটিস্টিক মানুষ শব্দ বা বাক্য বারবার বলতে হয়ত মজা পায়। এতে হয়ত একধরণের আত্মতৃপ্তি লাভ করে। যাই হোক, এই ব্যাপারটা দৈনন্দিন জীবনে ভাববিনিময়ে যথার্থ ভুমিকা রাখে না।
মেজাজ বোঝানোর পন্থাঃ ASD সমস্যায় আক্রান্ত ব্যাক্তিরা হয়ত নির্দিষ্ট কোন শব্দ বা শব্দগুচ্ছকে তার নির্দিষ্ট কোন আবেগের সঙ্গে মেলাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হয়ত কোন এস সময় রাগান্বিত অবস্থায় আপনি বললেন “আমার দেরী হয়েছে”। বিলম্বিত ইকোলালিয়ায় আক্রান্ত ব্যাক্তিটি রাগের সাথে এই বাক্যটিকে মনে মনে মিলিয়ে ফেলল। পরে সে যখন কোন বিষয়ে রাগান্বিত হয় তখন বলে দেয় “আমার দেরী হয়েছে”।

Functional (কার্যকর) ও   Non-Functional (অকার্যকর) ইকোলালিয়া

ইকোলালিয়া কোন কোন অটিস্টিক শিশুর ক্ষেত্রে অকার্যকরও হতে পারে। অকার্যকর ইকোলালিয়া হল যখন কোন শব্দ বা শব্দগুচ্ছ কোনকিছু বোঝানোর জন্য ব্যাবহার করা হয় না।

কোন সত্যিকারের শব্দ যখন অকার্যকর প্রতিধ্বনিত হয় অর্থাৎ শুধু শুধু প্রতিধ্বনিত হয় তখন তা বাবা-মা বা যে শিশুর যত্ন নেয় তার জন্য বিভ্রান্তিকর হয়। কারন যদিও মনে হবে শিশুটি কোন অর্থপুর্ণ ভাষা ব্যাবহার করছে, আসলে সে তা করছে না।
একটি শিশু হয়ত কোন কার্টুনের পুরো এপিসোডের স্ক্রিপ্ট মনে রাখতে পারে। কিন্তু একই সাথে এমনও হয় যে তারা কার্টুনের চরিত্রগুলোর বা গল্পটির অর্থ আসলে বোঝে না। এই ক্ষেত্রে মুখস্থ করা শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি কোন কোন অটিস্টিক শিশুর মধ্যে প্রশান্তির ভাব আনতে সাহায্য করতে পারে।
অন্যদিকে কার্যকর ইকোলালিয়াও রয়েছে। এই ক্ষেত্রে মুখস্থ শব্দগুলোকে অর্থপুর্ণভাবে ব্যাবহার করা যেতে পারে।
এটা একটা উদ্দেশ্য সাধন করবে। যেমন, শিশুটি হয়ত টেলিভিশনে একটি শব্দগুচ্ছ শুনতে পেল “তুমি কফি খেয়েছ?”।
পরে কখনও শিশুটি কফি খেতে চাইলে বলতে পারে “কফি খেয়েছ?” যেমনটি সে টিভিতে শুনেছিল। এটাই চচ্ছে ইকোলালিয়ার কার্যকর বা functional ব্যাবহার। শিশুটি আসলেই কফি খেতে চাইছে কিন্তু সে তার নিজের শব্দগুচ্ছ ব্যাবহার করছে না।

কিভাবে বুঝবেন আপনার শিশুর কার্যকর না অকার্যকর ইকোলালিয়া রয়েছে?

শিশুর কার্যকর না অকার্যকর ইকোলালিয়া রয়েছে তা সনাক্ত করা জরুরী। মুখস্থ করা বাক্যগুলো বা শব্দগুলো পরিস্থিতির সাথে খাপ খেতে পারে। মনে হতে পারে এগুলো ঠিকভাবে ব্যাবহার করা হয়েছে। কিন্ত আসলে হয়ত তা নয়।

আপনি হয়ত জানতে চাইলেন “তুমি দুপুরে কি খেয়েছিলে?” সে উত্তর দিল “চিকেন স্যান্ডউইচ”। সে হয়ত অন্য কোন ধরণের স্যান্ডউইচ খেয়েছিল কিন্তু বলার সময় টেলিভিশনে শোনা চিকেন স্যান্ডুইচ মনে করে বলে দিল।

তেমনি, কি ভাবছে তা প্রকাশ করতে তারা কার্যকরভাবেও শব্দগুচ্ছ ব্যাবহার করতে পারে কিন্তু ভুল পরিস্থিতিতে। এই প্রশ্নের কোন সাধারণ জবাব নেই।

ইকোলালিয়া সমস্যায় কি করা যেতে পারে?

দৈনন্দিন জীবন যাপনে ইকোলালিয়া একটি অন্তরায় হতে পারে। যাই হোক, এটাকে পুরোপুরি দূর করে ফেলার চিন্তা করাটা ভুল। ইকোলালিয়া অটিজম শিশুদের জীবনে মূল্যবান ভুমিকা রাখতে পারে।

কার্যকর ইকোলালিয়া আসলেই খুব উপকারি হতে পারে। এটা থাকার অর্থ হল আপনার শিশু তার চাওয়া পাওয়া প্রকাশের একটা রাস্তা বের করে নিয়েছে।  স্পীচ থেরাপিস্টের সাহায্য নিয়ে যোগাযোগের এই রাস্তাটাকে আরও প্রসারিত করা যেতে পারে।

অকার্যকর ইকোলালিয়ার ক্ষেত্রে স্পীচ এবং খেলা থেরাপি শুরু করতে এটা একটা বড় পয়েন্ট হতে পারে। শিশু হয়ত তার মুখস্থ করা শব্দগুচ্ছ বারবার উচ্চারণ করতে পারে। এটা তার উদ্বেগ প্রশমিত করার একটা পথ হতে পারে।  শিশুর এই রিপিট করার বিষয়টি তার চাওয়া পাওয়া বোঝার উপায় হতে পারে।

কার্যকর বা অকার্যকর যেই ইকোলালিয়াই হোক, পেশাদার থেরাপিস্টের মাধ্যমে খেলা এবং স্পীচ থেরাপির সাহায্যে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের ভাষা দক্ষতা অধিকতর সঠিকভাবে ব্যাবহার করায় এটাকে কাজে লাগানো সম্ভব।

আপনার শিশুর এই ইকোলালিয়া ভাষা নির্দেশিত চর্চার মাধ্যমে অধিকতর কার্যকর হতে পারে।

অধিকন্তু, নিজকে শান্ত করার জন্য শব্দগুছ ব্যাবহার সবসময়ই সমস্যা আচরন (Problem Behavior) থেকে শ্রেয়তর।

উপসংহারে বলা যায়, যেহেতু ইকোলালিয়াকে উদ্দেশ্য সাধনে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যায় সেহেতু এটাকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেয়ার চিন্তা করে নিজে উদ্বেগে থাকবেন না।